Sunday, April 5, 2020

বর্তমান লকডাউনের সময়ে উলামায়ে কেরাম ও সরকারের নির্দেশনা মেনে চলুন । ঘরে থাকুন-নিরাপদে থাকুন, সুস্থ থাকুন ও অন্যকে সুস্থ থাকতে সহায়তা করুন ।

*উলামায়ে কেরাম এবং সরকারের নির্দেশনা মেনে ঘরে থাকুন*

ইসলাম আমাদের যে কোনো পরিস্থিতির শান্ত ও সঠিক মূল্যায়নে উৎসাহিত করে। পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করণীয় সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বশর্ত। বর্তমানে যে বৈশ্বিক মহামারির পরিস্থিতি  তৈরি হয়েছে নিঃসন্দেহে তা ভয়াবহ। এ অবস্থায় কোনোরূপ ভাবাবেগের অনুগামী না হয়ে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের ও সরকারের দেওয়া শরয়ী নির্দেশনার উপর আমল করা অতি প্রয়োজন।

মুসলিম মাত্রেরই দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য যা লিখে রেখেছেন তা-ই ঘটবে। এর বাইরে কিছুই ঘটবে না। এই বিশ্বাস আমাদের ঈমানের অংশ। ইসলাম আমাদের এই ঈমানী শিক্ষা দান করেছে। একই সাথে যথাসাধ্য সতর্কতা অবলম্বন ও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাও প্রদান করেছে।

এই বিশ্বাস ও কর্ম-পন্থার সমষ্টিই হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। সাহাবা তাবেয়ীন ও সালাফে সালেহীনের নীতি ও কর্মপন্থাও তাই। বিশ্বাস ও কর্মের এই সমন্বিত আদর্শ অনুসরণ করাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য। নিঃসন্দেহে এটি তাকওয়া। তাকওয়ার মূল কথাই হচ্ছে আল্লাহর ভয় এবং যে অবস্থায় শরীয়তের যে নির্দেশনা তার অনুসরণ। শরীয়তে সাধারণ অবস্থায় যেমন সাধারণ বিধান রয়েছে তেমনি বিশেষ অবস্থায় আছে বিশেষ বিধানও। এটি শরীয়তের সৌন্দর্য ও অনন্য বৈশিষ্ট্য।

শরীয়তের বিধান ও নির্দেশনার ভেতরে থেকে বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা কিছুতেই তাকওয়া ও তাকদীরে-বিশ্বাসের পরিপন্থী নয়। মনে রাখতে হবে, তাকওয়া অর্থ বেপরোয়া হওয়া নয়, তাকওয়া অর্থ শরীয়তের নির্দেশনা পালনে সক্ষম হওয়া। আর এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও হক্কানী উলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্তই অনুসরণীয়।

দ্বীনদারী রক্ষা যেমন শরয়ী বিধি-বিধানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তেমনি দ্বীনদারীর সাথে জান-মালের সুরক্ষাও শরীয়তের বিধি-বিধানের অন্যতম লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। এ সম্পর্কেও আমাদের ফকীহগণ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং বিভিন্ন ফিকহী নীতি প্রণয়ন করেছেন। বিশদ আলোচনায় না গিয়ে এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে শুধু একটি ঘটনা আলোচনা করছি।

খুলীফায়ে রাশেদ হযরত ওমর ফারূক রা.-এর ঘটনাটি অনেকেরই জানা আছে। সংক্ষেপে তা এই যে, সাহাবায়ে কেরামের এক জামাতসহ তিনি যখন শামের নিকটে পৌঁছে সংবাদ পেলেন যে, ওখানে মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে তখন মুহাজির, আনসার ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের সাথে করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে পরামর্শ করেন। পরামর্শে আক্রান্ত অঞ্চলে প্রবেশ করা ও না-করা দুই রকমের মতই এল। রেওয়ায়েতে আছে যে, ওমর রা. প্রথমে মুহাজির সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করেছিলেন। তাদের পক্ষ হতে দুই রকম মত আসে। এরপর আনসার সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করেন। তাদের পক্ষ হতেও দুই রকম মত আসে। এরপর অন্যান্য বিচক্ষণ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করেন। তারা একমত হয়ে  আক্রান্ত অঞ্চলে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর ওমর রা. ঘোষণা করেন যে, তিনি মদীনায় ফিরে যাচ্ছেন।

এ সময় বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. এর সাথে তাঁর যে কথোপকথন হয়েছিল তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ তাঁকে বললেন

أَفِرَارًا مِنْ قَدَرِ اللَّهِ؟

আল্লাহর তাকদীর থেকে পলায়ন করে মদীনায় ফিরে যাচ্ছেন?

হযরত ওমর রা. বললেন,

لَوْ غَيْرُكَ قَالَهَا يَا أَبَا عُبَيْدَةَ؟ نَعَمْ نَفِرُّ مِنْ قَدَرِ اللَّهِ إِلَى قَدَرِ اللَّهِ، أَرَأَيْتَ لَوْ كَانَ لَكَ إِبِلٌ هَبَطَتْ وَادِيًا لَهُ عُدْوَتَانِ، إِحْدَاهُمَا خصبَةٌ، وَالأُخْرَى جَدْبَةٌ، أَلَيْسَ إِنْ رَعَيْتَ الخَصْبَةَ رَعَيْتَهَا بِقَدَرِ اللَّهِ، وَإِنْ رَعَيْتَ الجَدْبَةَ رَعَيْتَهَا بِقَدَرِ اللَّهِ؟

হে আবু উবাইদা! কথাটি যদি আপনি ছাড়া অন্য কেউ বলত! জ্বী, আমরা আল্লাহর তাকদীর থেকে আল্লাহর তাকদীরের দিকেই পলায়ন করছি। দেখুন, আপনার উটের পাল যখন কোনো চারণ ভূমিতে নামে, এর এক পার্শ্বে যদি তৃণলতাপূর্ণ সজীব ভূমি থাকে, অন্য পার্শ্বে থাকে বিরাণ ভূমি,  তখন আপনি সজীব ভূমিতে সেগুলোকে চরানোর ব্যবস্থা নিলে তা কি আল্লাহর তাকদীরের কারণেই নয়? ……. সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭২৯

অর্থাৎ যথাসময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত ও যথার্থ ব্যবস্থাগ্রহণে সক্ষম হওয়াও তাকদীরের অন্তর্ভুক্ত। নিঃসন্দেহে তাকদীরে যা আছে তাই ঘটবে, কিন্তু মানুষের জানা নেই কী তার তাকদীরে আছে। তাকদীরে ভালো থাকলে ভালোর উপযোগী সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণই তার জন্যে সহজ হবে।

অতএব যথাসময়ে সঠিক করণীয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম হওয়াও একটি লক্ষণ যে, সম্ভবত তার পক্ষে আল্লাহর ফয়সালা ভালো।

বান্দার কর্তব্য, বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা এবং জান-মাল, ইজ্জত-আবরু ইত্যাদি রক্ষার ক্ষেত্রেও শরীয়ত-প্রদত্ত প্রশস্ততা গ্রহণে সচেষ্ট হওয়া। এটিও আল্লাহর পক্ষ হতে কল্যাণ-প্রার্থনার ও কল্যাণের প্রতি মুখোপেক্ষিতা প্রকাশের অন্যতম উপায়। তবে হাঁ, নীতিটি বলতে বা শুনতে যত সহজ বাস্তব ক্ষেত্রে এর সঠিক প্রয়োগ তত সহজ নয়। এর জন্যে বিজ্ঞ ও মুত্তাকী আলিমের দিক-নির্দেশনা অতি প্রয়োজন।

*উপরোক্ত নীতির আলোকে আমরা বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। আমরা ইতিমধ্যে দেখছি যে,*

এক. করোনা ভাইরাসটি গোটা পৃথিবীতে ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও বিশ্বজুড়ে অচিন্তনীয়ভাবে বেড়ে চলেছে। ভারতেও আক্রান্তের হার বাড়ছে ( আল্লাহ তাআলা হেফাযত করুন।)

দুই. বিষয়টির প্রকৃতি ও ভয়াবহতাও ইতিমধ্যে আলোচনায় এসেছে। বিষয়টি বোঝার দুটি উপায় রয়েছে,

ক. সাধারণ বিচার-বুদ্ধি এবং  খ. বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত।

সাধারণ বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ একটু চিন্তা করলেই বিষয়টির ভয়াবহতা বুঝতে পারবেন। পৃথিবীর দেশে দেশে একের পর এক লকডাউন ঘোষিত হয়েছে। কয়েকটি উন্নত রাষ্ট্রেও প্রথম দিকে এই ভাইরাস স্বল্পমাত্রায় ও মন্থরগতিতে ছড়ালেও একটা পর্যায়ে এসে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কোথাও কিছুটা ‘নিয়ন্ত্রণে’ এসেছে কোথাও এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

সৌদি আরবে পূর্ণ লক ডাউন সত্তে¡ও আক্রান্তের হার বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশে এখনও আক্রান্তের সংখ্যা  অনেক বাড়ছে। (আল্লাহ হেফাযত করুন।)

খ. উপরোক্ত বিষয়গুলোর পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ চিকিৎসক, অণুজীব বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও ভাইরাসটির ধরন ও বিস্তারের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাদের সম্মিলিত বক্তব্য ও মতামতকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। শরীয়তে প্রত্যেক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভারসাম্যপূর্ণ মূল্যায়ণের নীতি ও নির্দেশনা আছে।

তিন. সব ধরনের জমায়েত থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি জুমা-জামাতের প্রসঙ্গটিও আলোচনায় এসেছে।

জুমা-জামাতের দুটো দিক রয়েছে। এক. সাধারণভাবে মসজিদে জুমা-জামাত কায়েম থাকা।  দুই. ব্যক্তিগতভাবে জুমা-জামাতে শামিল হওয়া।

মসজিদ, মসজিদের আযান, জামাত, জুমা এগুলো যেহেতু ইসলামের শি‘আর ও নিদর্শন তাই ন্যূনতম পর্যায়ে হলেও যথাসাধ্য তা কায়েম রাখার চেষ্টা করা কাম্য।

আর প্রত্যেক ব্যক্তির জুমা-জামাতে শামিল হওয়ার প্রসঙ্গে সাধারণ অবস্থায় ওজরহীন সাবালক পুরুষের জন্য মসজিদের জামাতে শামিল হওয়া বিশেষভাবে কাম্য হলেও বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতিতে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে।

চার. বর্তমান পরিস্তিতিতে জুমা-জামাত বিষয়ে মুসল্লীদের করণীয় সম্পর্কে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও এসে গেছে।

*নির্দেশনা কি কি অন্য আর্টিকেলে বর্ণনা করা হয়েছে সেটা আর বর্ণনা করার প্রয়োজন বোধ মনে করছেন।*

মনে রাখতে হবে যে, বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতিতে বিশেষ বিধান অনুসারে আমল করা এবং শরীয়তের ছাড় ও প্রশস্ততা গ্রহণ করাও তাকওয়া। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁর আনুগত্যের প্রেরণা নিয়ে এর অনুসরণ আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের এবং তাঁর রহমত লাভের উপায়।

একইসাথে আরো যে বিষয়গুলো লক্ষণীয় তা হচ্ছে :

এক. সব রকমের গুনাহ ও পাপাচার বর্জন করে একান্তভাবে আল্লাহ-অভিমুখী হোন। তাওবা-ইস্তিগফার, দুআ-কান্নাকাটি, বেশি বেশি দরূদ পাঠ, কুরআন তিলাওয়াত, বিশেষত বালা মুসিবত থেকে মুক্ত থাকার আমলগুলোতে নিজেও মশগুল থাকুন, ঘরের স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকেও মশগুল রাখুন। একই সাথে উলামায়ে কেরাম এবং চিকিৎসক ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে দেওয়া সতর্কতামূলক নির্দেশনা-বিধিগুলোও মেনে চলুন।

দুই. ঘরে অবস্থানের সময়টুকুতে পরস্পরিক সুসম্পর্ক, সৎ ব্যবহার ও উত্তম আখলাকের চর্চা করুন। তবে সময় কাটানোর জন্য কোনো কোনো মহলের পক্ষ হতে প্রস্তাবিত ও সরবরাহকৃত বিভিন্ন মুভি ইত্যাদিতে লিপ্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাকুন।

স্ব স্ব পরিসরে প্রত্যেকে অন্যের সাথে কোমল ও দয়ার আচরণ করুন। দরিদ্র অভাবীদের প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসুন। হাদীস শরীফে আছে, তোমরা যমীনওয়ালাদের উপর রহম করো, তাহলে আসমানওয়ালা তোমাদের উপর রহম করবেন।

তিন. সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমগুলোতে সাধারণত যা হয়ে থাকে পরস্পর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, কটাক্ষ ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করুন। কারো মনে কষ্ট দেয়ার মতো কথা ও কাজ, বিশেষত মুত্তাকী উলামায়ে কেরাম এবং বৃদ্ধ-বয়স্ক ইবাদতপ্রাণ ব্যক্তিদের সম্পর্কে কট‚ মন্তব্যের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করুন। মনে রাখতে হবে যে, এখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আল্লাহর রহমত। ব্যবস্থা যা কিছুই  আমরা গ্রহণ করি, আমাদের রক্ষা করবেন একমাত্র আল্লাহ। যারা আক্রান্ত হয়েছেন আল্লাহর হুকুমেই আক্রান্ত হয়েছেন, যারা রক্ষা পাবেন আল্লাহর হুকুমেই রক্ষা পাবেন।

তাই আল্লাহ তাআলা নারাজ হন এমন সব কথা, কাজ ও আচরণ থেকে অবশ্যই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।

চার. প্রত্যেক মুমিন একে অপরের জন্য দুআ করুন। এক মুমিনের অনুপস্থিতিতে অন্য মুমিনের দুআ বিশেষভাবে কবুল হয়ে থাকে।  আর এক মুসলিম যখন অন্য মুসলিমের জন্য কল্যাণের দুআ করেন তখন ফেরেশতাগণ তার জন্য অনুরূপ কল্যাণ প্রার্থনা করেন।

পাঁচ. শবে বরাতে অর্থাৎ ১৪ শা‘বান (বৃহস্পতিবার) দিবাগত রাতে নফল ইবাদতের জন্য মসজিদে জমায়েত হওয়া থেকে বিরত থাকুন। নিজ নিজ ঘরে আমল করুন। বেশি বেশি দোআ ইস্তিগফারে মশগুল থাকুন এবং মুক্তির এ রজনীকে পাপ-মুক্তির, রোগ-মুক্তির ও বালা-মুসিবত থেকে মুক্তির  সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করুন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হেফাযত করুন এবং তাঁর রহমতের নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে রাখুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।

No comments:

Post a Comment