Thursday, January 21, 2021

প্রচলিত ওয়াজ মাহফিল সংস্করণ ও উত্তরণ



মুসলমান আমরা । সৎ পথের আদেশ এবং অসৎ পথের নিষেধ আমাদের বৈশিষ্ট্য । কেয়ামত অবধি পৃথিবীতে আর কোনো নবী প্রেরিত  হবেন না । মহাপ্রলয় পর্যন্ত আল্লাহ প্রদত্ত কোন ধর্ম আত্মপ্রকাশ করবে না । মানব জাতিকে একত্ববাদের দাওয়াত প্রদান, শুভ্র-শ্বাশত ইসলামের দিকে আহ্বান, ইসলামের মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের জায়গান, অন্যসব অন্ধকার ধর্ম ও মতের অসারতা প্রমাণ উলামায়ে কেরামের অপরিহার্য ধর্মীয় দায়িত্ব । এ দায়িত্ব সত্যিই গুরুদায়িত্ব । মহানবী সাঃ এর অবর্তমানে ঝর্ণা-স্বচ্ছ, শিশির-শুভ্র ইসলামের প্রসার, তাঁর গুরুত্ব ও মহত্বের প্রচার, উম্মাহর আত্মিক ও বাহ্যিক উন্নতি সাধন, তাদের উন্নত ও আদর্শ চরিত্র গঠন, তাদের হৃদয়- মানসে আমলের গুরুত্ব স্থাপন এবং তাদের চলাফেরা, উঠাবসা, বেশাভূশায় ইসলামী সভ্যতার উদয় ঘটানো উলামাদেরই দায়িত্ব । উলামায়ে কেরাম যুগ যুগ ধরে এ দায়িত্ব পালনে ব্রতী আছেন বিভিন্নভাবে । কেউ কলমের ভাষায়, কেউ মুখের কথায়, আর কেউ আলোচনা সভায় ।

ইসলামের দাওয়াত-তারবিয়াত, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা, সভ্যতা ও দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, গুরুত্ব-মহত্ব, সেই কাফেলার পূত পবিত্র হাত ধরেই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছবে কেয়ামত পর্যন্ত ।

আমাদের বরাক উপত্যকায়ও ইসলাম আছে । আছেন লক্ষ লক্ষ মুসলমান । হাজার হাজার উলামায়ে কেরামের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এখানে । এখানকার মুসলমানদেরকে ইসলামের প্রকৃত চিন্তা-দর্শন, কৃষ্টি -কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত করে আদর্শ মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলা উলামায়ে কেরামের একান্ত দায়িত্ব । এ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট আছেন একদল উলামায়ে রাব্বানি । যাদের আছে ইখলাস ও নিষ্ঠা । যাদের আছে ইলম ও আমল। যাদের আছে তাকওয়া ও পরহেজগারী। যাদের আছে দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা।  যাদের আছে উম্মাহের দরদ ও জ্বলন। যাদের আছে চিন্তা-চেতনা। যাদের  আছে বেগ- আবেগ। যাদের আছে ত্যাগ-তিতিক্ষা । যাদের আছে মহাব্বত ও কুওয়াত। যাদের হৃদয় হিংসামুক্ত। যাদের আকিদায় নেই শিরকের কায়া, বিদায়াতের ছায়া। তাঁরা দ্বীন ও মিল্লাতের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন দিন-রজনী । 

বরাকে ইসলাম প্রচার চলছে নানা তরিকায় । যার অন্যতম মাধ্যম ওয়াজ মাহফিল । শুকনো মওসুমে এ অঞ্চলে ওয়াজ মাহফিলের হিড়িক পড়ে যায় । উপত্যকার কোনও এলাকা বাদ যায় বলে মনে হয় না ।‌  কান পাতলেই শোনা যায় ওয়াজের আওয়াজ ।

প্রচলিত ওয়াজ মাহফিল উম্মাহর জন্য কতটা সুফল বয়ে আনে? জাতিকে আলোর পথ কতটা দেখায়? কতটা ভাবায় ? কৌমের হৃদয় কি আলোড়িত হয়? হয় আন্দোলিত? কতখানি প্রভাবিত হয়? উম্মাহ কী কুশিক্ষা আর কুসংস্কার থেকে মুক্তি পায়? সবুজ পথের দিশা পায়? সর্বোপরি জাতির উপর কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে? এটা কিন্তু ভাবনার বিষয় । চিন্তার বিষয়,গভীর চিন্তার বিষয় । অপর দিকে ওয়াজ মাহফিলের কী কী নেতিবাচক দিক রয়েছে । নেতিবাচক প্রভাবে কৌম কতটা প্রভাবিত হয়, তাও আলোচনা করা সময়ের দাবি।

শুকনো মরসুম আসে আবার চলে যায়। শীত-বসন্ত আসে আবার চলে যায়। ওয়াজ মহফিলও যথারীতি আয়োজিত হয় । কিন্তু জাতি এতে পায় কি ? আর দেয় কী? জাতি যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরে থেকেই যায়। সমাজে পরিলক্ষিত হয় না কোনো পরিবর্তন । এ আবার কেমন দৃশ্য! ফোঁটা ফোঁটা জল শক্ত পাথরে নিক্ষিপ্ত হতে থাকলেও তো একসময় গর্ত তৈরি হয় । জাতির হৃদয় কি পাথরের চেয়েও শক্ত? উলামায়ে কেরাম কি জলফোঁটা থেকে কমজুর? না, না মোটেও না, তেমনটা  ভাবার অবকাশ ও নেই । তাহলে? এ জাতি কী উলামায়ে কেরামের কথা কানে তুলে না । তাঁরা কী পরিবর্তন বিরোধী, উন্নয়ন বিরোধী, ইসলামী আদর্শ বিরোধী । না, না । তাহলে নেই কেন পরিবর্তন? কী তার রহস্য? আসুন একটু খোঁজে নিই।

একঃ ওয়াইজ সাহেবের নিষ্ঠার অভাব । ওয়াইজ সাহেব আসেন সমাজকে দিশা দেখাতে নয়, নাম ফাটাতে । কৌমকে জাগ্রত করতে নয়, টাকা কামাতে । জাতির সামনে ইসলামের শিশির-শুভ্র আদর্শ উপস্থাপন করতে নয়, সুর বাজাতে । আল্লাহ বিমুখ বনিআদমকে আল্লাহর ভয় দেখানোর জন্য নয়, বাজার ধরতে । দুনিয়ামুখী মুসলমানদের আখিরাতমুখী করতে নয়,খ্যাত-বিখ্যাত হতে । তাঁদের অন্তরে নেই কৌমের কোন করুণা । নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা । না করেন তথ্য ভিত্তিক আলোচনা । তবে ব্যতিক্রমও চোখে পড়ে । এমন আলোচনায় শ্রুতাদের মন হয় না আলোড়িত । হৃদয় হয় না অশ্রু বিগলিত । নবীপ্রেমে মন-মানস হয় না প্লাবিত ।

দুইঃ আয়োজকবৃন্দের ইখলাস শূন্যতা । মাহফিল আয়োজকদের আখের গোছানোর চিন্তা থাকে । থাকে না দিশাহারা উম্মাহর ইসলাহের ভাবনা  । চাঁদা আদায় আর প্রতিষ্ঠানের গৌরবগাঁথা প্রচারই তাদের হয়ে উঠে মূল লক্ষ্য।

তিনঃ আয়োজকবৃন্দের  উদাসীনতা । বিষয় ভিত্তিক বক্তব্যের ব্যাপারে তারা নিরুৎসাহী। আর উলামায়ে কেরাম কিসসা কাহিনী আর হাস্যরস সম্পন্ন আলোচনা করেন মুগ্ধতা ছড়ানো কন্ঠে। আকর্ষণীয় অঙ্গ ভঙ্গিমায়। তবে সব নয়। তাঁদের বয়ানে সঙ্কটঘেরা জাতির উত্তরোণের কোন দিশা থাকে না। কুরআন ও সুন্নাহর নিগূঢ় রহস্য উদঘাটিত হয় না। জাতি পায় না কোন তৃপ্তি ও পরিতৃপ্তি। সিরাতের সুনির্দিষ্ট আলোচনায় নবীপ্রেমের সাগরে ঢেউ উঠে না। 

‌তিনঃ অচেতন শ্রুতাবৃন্দ।  সিংহ ভাগ শ্রুতা অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত। তারা অনেকটা নির্বোধ। ওয়াজ মাহফিলে কী শুনলেও, কী লিখলেন? এ নিয়ে নেই কোন মাথা ব্যাথা। শুধু আকর্ষণীয় সুর হলেই হল। 

চারঃ ওয়াইজগণ কুরআন সুন্নাহকে পিছনে ফেলে নিজেদের সংগঠন ও পীরতন্ত্রের গৌরবগাঁথা তুলে ধরতে উদগ্রীব। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে অন্য মতাদর্শীদের প্রতি শাণিত আক্রমণ। প্রকাশ্যে শর বর্ষণ। কল্পনাতীত বিষেদগার । বর্ণনাতীত মিথ্যাচার করে থাকেন নির্দ্ধিধায়। তখন ভক্তদের স্লোগানে গগন-পবন মুখরিত হয়ে ওঠে। এতে ভক্তবৃন্দের মন ঘৃণা-বিদ্বেষে ভরে উঠে। জাতির দুর্গতি ঘোচে না; জন্ম নেয় দুর্মতি।রহমাতের অমীয়ধারার সয়লাভ বয়ে যায় না। তাছাড়া বাড়তি হিসেবে ভীন ধর্মীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। 

পাঁচঃ আর্থিক অপচয়। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে আয়োজিত হয় একেকটি মাহফিল। অথচ ফলাফল বলতে গেলে নিটশূন্য। আয়োজকবৃন্দ যোগ্য আলোচক নির্বাচনে সংগঠনের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যায়। সংগঠনের খাতিরে অপেক্ষাকৃত অযোগ্যকে বেছে নেয়। ফলে আশানুরূপ ফল পরিলক্ষিত হয় না।

উত্তরণের উপায়
একঃ সূযোগ্য উলামায়ে কেরামকে দাওয়াত করা হবে। এক্ষেত্রে থাকবে না সংগঠন বা পীরতন্ত্রের কোনও বেড়াজাল। 

 দুইঃ আয়োজকবৃন্দ সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত করা। অতঃপর ওয়াইজ সাহেবানদের সাথে আলোচনা করে নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে আগে অবগত করা।

তিনঃ পরীক্ষার মরসুমে যথাসম্ভব ওয়াজ মাহফিল মাহফিল আয়োজন না করা। এতে জাতির ভবিষ্যৎ পড়ুয়াদের বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়।(ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা চলাকালীন ওয়াজ মাহফিলের জন্য বড্ড সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম)। 

চারঃ ওয়াইজ সাহেবকে নির্ধারিত বিষয় সম্পৃক্ত কিতাবাদি ঘাঁটাঘাঁটি করে তথ্য ও তত্ত্ব সমৃদ্ধ আলোচনা করার চেষ্টা করা

পাঁচঃ বক্তব্য সমাপনের পর ছোট্ট প্রশ্নোত্তর পর্বের আয়োজন করা। এতে কারো প্রশ্ন বা দ্বিধা থাকলে তা সহজে বিদূরিত হবে। 

ছয়ঃ এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ,রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী ভিন্নধর্মীদের যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে মাহফিলে আমন্ত্রণ করা। এতে  দুটি ফায়দা নিহিত রয়েছে। প্রথমতঃ ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগ। দ্বিতীয়তঃ ইসলাম সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির অবসান।

সাতঃ মাহফিলের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় না করে মুসলমানদের শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় করা। এতে এক আশ্চর্য বিপ্লব দেখা দেবে। জাতি শিক্ষিত হবে। সচেতন হবে। উন্নতির শিখরে আরোহণ করবে। ধীরে ধীরে কৌমের আর্থ-সামাজিক সহ সার্বিক উন্নয়ন আসবে। সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

আটঃ মসজিদে মসজিদে জুমার দিনে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করা। এটা হবে স্থায়ী দাওয়াত ও নসিহত। ফলাফল হবে যার সুদূর প্রসারী।  

নয়ঃ গ্রামে গ্রামে জিকিরের হালকা গড়ে তুলা। এতে মানুষের আত্মিক ও চারিত্রিক উন্নতি হবে। আল্লাহ এর নৈকট্য লাভ হবে।  সৎগুণ জন্মাবে। কুপ্রবৃত্তি বিদূরিত হবে। কল্যাণ ও পবিত্রতা এবং পূণ্য ও সততার নূরে নূরান্বিত হবে সমাজ।

 দশঃ এলাকা ভিত্তিক সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক তাফসির মাহফিল আয়োজন করা । কোনো খরচ ছাড়াই কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক আলোচনা হবে এটা । স্থায়ীত্বও থাকবে । 

এগারোঃ মসজিদে মসজিদে ছোট ছোট লাইব্রেরী গড়ে তোলা । এতে মানুষ বিভিন্ন পত্রিকা ও বই পুস্তক পাঠ করে সঠিক পথের দিশা পাবে। সমাজে সচেতনতা বাড়বে ।

বারোঃ খানকা প্রতিষ্ঠা করা ।এতে নির্দিষ্ট তরিকায় জিকির আজকারের প্রশিক্ষণ লাভ করে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হবে। ধূলার ধরণীতে অবস্থান করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠবে।

No comments:

Post a Comment