ভাষা আন্দোলন আসাম তথা বরাকের সর্ববৃহৎ গণ আন্দোলন । এই আন্দোলন সর্বাত্মক সার্থক ও সফল আন্দোলন । আন্দোলনকে সফলতার চরম শিখরে পৌঁছাতে যে ক'জন বিপ্লবী নেতা জীবন বাজি রেখে লড়েছিলেন,তন্মধ্যে অন্যতম মাতৃভাষাব্রতী, সিংহপুরুষ মওলানা আব্দুল জলীল চৌধুরী । তাঁর অবদান কস্মিনকালেও ভুলা সম্ভব নয়।
১৯৬০ সালের ১০ ডিসেম্বর তৎকালীন চলিহা সরকারের মন্ত্রীসভা আসাম সরকারী ভাষাবিল পেশ করেছিল ,যা একমাত্র সংখ্যার জোরে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৬০ সালে আইন হিসাবে পাশ করে নেয় । এই আইন অসমীয়া ভাষাকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে । যেটা আসামের বাঙালীদের ভাবাবেগে চরম আঘাত দেয় । এই আইন প্রতিরোধ করতে প্রতিবাদে বরাক উপত্যকার কংগ্রেস দল একজোট হয়ে উঠে । সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক সংগঠনও। কালক্রমে ১৫ জানুয়ারী ১৯৬১ সালে অনুষ্ঠিত জনসম্মেলনের মাধ্যমে "কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ '' গঠিত হয় । এই পরিষদের সভাপতি ছিলেন তরুণ এডভোকেট আব্দুর রাহমান চৌধুরী । সংগ্রাম কমিটি বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলে । অপরদিকে সরকারের পরোক্ষ মদতপুষ্ট কতিপয় স্বার্থান্বেষী, মানুষদের আন্দোলন থেকে দূরে ঠেলতে থাকে । চালাতে থাকে বরাকের অলিতে-গলিতে অপপ্রচার । দেখাতে থাকে অহেতুক ভয়ভীতি । গ্রামাঞ্চলের সরলমনা মানুষ এই দুষ্টচক্রের অপপ্রচারে প্রভাবিত হয় এবং অসমীয়া ভাষার পক্ষে সওয়াল করে । আন্দোলন স্তব্ধ হওয়ার উপক্রম ।
এহেন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন জননেতা আব্দুল জলীল চৌধুরী । তিনি বরাকের মানুষদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে বরাকের নানা প্রান্তে সভা-সমিতি করেন । তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণে দিশেহারা মানুষের ভ্রান্ত ধারণা বিদূরিত হয় । তিনি গণিরগ্রাম জে, আর হাইয়ার সেকেণ্ডারী স্কুলে এক প্রতিবাদী সভায় মাতৃভাষা প্রসঙ্গে বলেন, আমি মাত্র আপনাদের কাছে একটা কথা জানতে চাই "আপনারা কাহারা নিজের মাকে ভুলিতে পারিবেন ? " তখন সকলে এক বাক্যে বলিলেন তা কখনো হতে পারে না । তিনি লোকজনের আওয়াজ শুনে বলিলেন, ''তাহা হইলে আমি আব্দুল জলীল সরকারের একজন হওয়া সত্বেও বলিতেছি যে আমরা বাংলাবাসী লোক ,আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা ,আমি এক মুহূর্তের জন্য আমার মায়ের মুখ বন্ধ করিতে চাই না।" তখন উপস্থিত সবাই বলে উঠলেন "চাই না, চাই না ''। সেদিন থেকে পশ্চিম কাছাড় অঞ্চলে জোরদমে আন্দোলন শুরু হয় । কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় , সভা-সমিতি করতে অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হন । আক্রান্ত হন অনেকবার । গাড়িতে ইট পাটকেল বর্ষণ হয় একাধিকবার । প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয় । শালচাপড়ার এক সভা থেকে আসার পথে প্রাণঘাতী হামলার শিকার হন । তারপরও বিচলিত হননি ।এক ইঞ্চিও পিছু হটেননি এ বীর যোদ্ধা । বরং পুরোদমে চালাতে থাকেন সভা-সমিতি, আন্দোলন ।
তাঁরই শক্তিশালী নেতৃত্বে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৬১ সালের ১৯ মে প্রাণ দিতে ও কুন্ঠাবোধ করেননি ১১ জন ভাষা সেনানী। কিন্তু এ বীর শহিদদের নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর প্রতিক্রিয়া ইতিহাসের পাতায় কালো অক্ষরে লেখার মতো । শোক প্রকাশ তো দূরের কথা উল্টো বলে বসেন , " যারা রেল ষ্টেশনে অগ্নিসংযোগ করায় তাদের পুলিশ গুলি করবে না তো ফুল ছিটাবে কি !" তাঁর এ মন্তব্যে তোলপাড় হয় গোটা উপত্যকা । তখন এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদ,সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করার অপপ্রচেষ্টা চালায় । মওলানা জলীল সাহেবের তৎপরতায় কিন্তু তা সম্ভবপর হয়নি । সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখতে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা বরাকের ইতিহাসে জাজ্বল্যমান থাকবে । থাকবে চিরস্মরণীয় । তিনি বলেছিলেন , "ভাই সকল,আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে যারা চায়, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন, আমাদের এই আন্দোলন অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন । " তিনি উদ্বাত্ত কন্ঠে বলেছিলেন , "ভাষিক সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা কোন শক্তির নাই । '' তাঁর অগ্নিগর্ভ ভাষণে বরাক উপত্যকায় সৃষ্টি হয়েছিল এক সাম্প্রদায়িকতামুক্ত আন্দোলন । তাঁর এ মন্ত্রে দীক্ষিত হন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙালী । রাজ্য সরকার ব্যর্থ হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় Divide & Rule নীতি অনুসরণ করে বরাক উপত্যকার মানুষকে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভাজন করতে ।
আন্দোলনের গতিবিধি অপ্রতিরোধ্য অনুধাবন করে প্রধানমন্ত্রী নেহরু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাস্ত্রীকে আসামে পাঠান । অবস্থা পর্যালোচনাক্রমে শাস্ত্রীজি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মত বিনিময়ের উদ্দেশ্যে তিন সদস্যের এক প্রতিনিধিদলকে দিল্লির আমন্ত্রণ জানান । প্রতিনিধিদলে ছিলেন আসামের প্রাক্তন মন্ত্রী মরহুম আলতাফ হুসেন মজুমদার, মওলানা আব্দুল জলীল চৌধুরী ও করিমগঞ্জের রথীন্দ্রনাথ সেন । প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর দরবারে হাজির হন । তখন প্রধানমন্ত্রী চটে লাল হয়ে বলেন, আপনারাই বোধহয় কাছাড়ের ১১ জন বাঙালির খুনি ? একথা শোনা মাত্র সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রমী চরিত্র মওলানা আব্দুল জলীল চৌধুরী । তিনি বলেন," ১১ জন কেন ? আমাদের সংগ্রামের নৈতিকতা বিচার করে আমাদের বাংলা ভাষার অধিকার না দিলে আসামের সমগ্র বাঙালি মানুষ প্রাণ দিতে বিচলিত হব না ।''
বিরোচিত জবাব শুনে প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার নির্দেশ দেন। শাস্ত্রীর সাথে আলোচনার পর দশ বছরের জন্য অসমীয়া ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং পুলিশের গুলিচালনার তদন্তের জন্য মেহেরাত্রা কমিশন গঠিত হয় । মেহেরাত্রা কমিশনের রিপোর্টের অপেক্ষায় আজও জাতি অপেক্ষমান ।
দশ বছর পূর্তিতে ১৯৭২ সালে সেবা আসামের সমগ্র মাধ্যমিক স্কুলসমূহে অসমীয়া ভাষা বাধ্যতামূলক করতে নির্দেশ জারি করে। আবার জ্বলে উঠে বরাক । গর্জে উঠেন আন্দোলনকারী । গঠন করেন সংগ্রাম পরিষদ । বরাক উপত্যকার সকল নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনে নেতৃত্বের জন্য মওলানা চৌধুরীকে অনুরোধ করেন । তাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে শাসক দলের বিধায়ক হওয়া সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত ভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন । সংগ্রাম পরিষদের কার্যকরী সভাপতি নির্বাচিত হন অধ্যাপক মেহরাব আলি লস্কর এবং সম্পাদক হন তারাপদ ভট্টাচার্য ।
মওলানা সাহেবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পরিচালিত এ আন্দোলনে প্রায় দু-মাস সরকারি কাজকর্ম অচল হয়ে পড়ে । ইতিমধ্যে আসাম বাজেট অধিবেশন আরম্ভ হয় । সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বরাক উপত্যকার মন্ত্রী সহ কোন বিধায়ক অধিবেশনে উপস্থিত না হয়ে অধিবেশন বয়কট করার অনুরোধ জানানো হয় । কিন্তু গদির লালসা মওলানা চৌধুরী ও সরবরাহ মন্ত্রী মহীতোষ পুরকায়স্ত ব্যতিত কাউকে আটকাতে পারেনি । এমনকি পুরকায়স্তবাবু মন্ত্রিপদ খুইয়ে বসেন ।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কে সি পন্থের আহ্বানে, মওলানা সাহেবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সংগ্রামী নেতৃ্বৃন্দ শিলঙে একটি গোল টেবিল বৈঠক করেন । সেই গোল টেবিল বৈঠকেই ঐতিহাসিক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা "সিংহ -পন্থ -জলীল" চুক্তি নামে পরিচত । মওলানা আব্দুল জলীল আন্দোলন পরিষদের সভাপতি হিসাবে, শরৎচন্দ্র সিংহ আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কে সি পন্থ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন । এছাড়াও আরও দশজন সাংসদ ও বিধায়ক এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ।এই চুক্তির শর্তানুসারে মাধ্যমিক অবধি অসমীয়ার সঙ্গে বাংলা ভাষায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় । এই চুক্তির সুবাদে আজও বরাক উপত্যকায় ছাত্র-ছাত্রীরা মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে লেখাপড়ার সুযোগ ভোগ করছে ।
প্রতিবছর ১৯ মে ভাষা শহিদ দিবস হিসাবে পালন করা হয় ।কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ,যাঁর নেতৃত্বে এত বড় একটি গণ-আন্দোলন হয়েছিল ,যার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ,তাঁর যথোপযুক্ত মূল্যায়ন হয় না সেই শহিদ দিবসে ।
No comments:
Post a Comment