Thursday, May 18, 2023

◆◆◆বাংলা ভাষা আন্দোলনে মাওলানা আব্দুল জলিল চৌধুরীর অবদান◆◆◆ পৃথিবীতে কত ভাষা কত জাতি তার সঠিক কোন হিসেব নেই। বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন ভাষা। কারো ইংরাজি, কারো হিন্দি, কারো আরবি, কারো বাংলা প্রভৃতি এরকম প্রায় চৌদ্দ হাজার ভাষা এজগতে প্রতিষ্টা লাভ করেছে। শুধুমাত্র আমাদের দেশ ভারতবর্ষে ১৬৫৭ টি ভাষা উপভাষা বিদ‍্যমান রয়েছে। তা থেকে কিছু ভাষা জাত- উপজাত হয়ে এসেছে। এতে কোনো কোনো ভাষা এমনিতেই বিনা সংগ্রাম বা আন্দোলনে প্রতিষ্টিত হয়েছে। আবার কোনো কোনো ভাষা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ‍্যমে প্রতিষ্টা লাভ করেছে। তন্মধ্যে বাংলা ভাষা অন‍্যতম। ১৯৬০ সালে আসাম বিধানসভায় চালিহা সরকারের শাসনামলে ভাষা বিল গৃহীত হয়। ফলে আসাম সরকার বলপূর্বক রাজ‍্যের সবকটি জেলার অফিস আদালতের কাজে অসমীয়া ভাষা চালু করার নির্দেশ জারি করে। এহেন পরিস্থিতিতে অত‍্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে অসমীয়া ভাষা চালু করার প্রতিবাদে বরাক উপত‍্যকায় একটি সমন্বয় কমিটি গঠণ করা হয়। এতে আব্দুর রহমান চৌধুরীকে সভাপতি ও নলিনীকান্ত দাসকে সাধারণ সম্পাদক সহ ত্রিশ সদস্য বিশিষ্ট কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামে এক বলিষ্ট কমিটি গঠণ করা হয়। বৃহত্তর আন্দোলনে তৎকালীন করিমগঞ্জ মহকুমায় সংগ্রাম পরিষদের স্টিয়ারিং কমিটি গঠণ করা হয়। এতে আসাম বিধানসভার ছয়বারের বিধায়ক, দেওরাইল টাইটেল মাদ্রাসা বদরপুরের অধ‍্যক্ষ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা আব্দুল জলিল চৌধুরী সাহেবকে সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়। তিনি বরাক উপত‍্যকার বিভিন্ন স্থানের সভা সমিতিতে উপস্থিত হয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদানের মাধ্যমে গণচেতনায় মানবমণ্ডলীকে উদ্বুদ্ধ করেন। সেসময় একাংশ উলামায়ে কেরাম ভাষা আন্দোলনের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু প্রয়াত মাওলানা আব্দুল জলিল চৌধুরী সাহেব সেসব উলামায়ে কেরামগণকে বলেছিলেন- “ মাতৃভাষাকে যারা শ্রদ্ধা করে না তারা ঈমানের দাবিদার হতে পারে না।” শিলচর শহরের উপকণ্ঠে সোনাই বাজারে ভাষণ দান শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে শালচাপড়ায় কতিপয় দুষ্কৃতির চক্রান্তে পড়ে প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। এরকম বিভিন্নভাবে মাওলানা জলিল সাহেব ভাষা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৬১ সালের ঐতিহাসিক ১৯ শে মে শিলচর রেল স্টেশনে পুলিশের গুলিতে ভাষা প্রেমিক এগারোটি তরুণ তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যাওয়ার পর তাদের অন্ত‍্যেষ্টিক্রিয়ার দিন বরাক উপত‍্যকার প্রতিটি সংগ্রাম কমিটির অফিসে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠের মাধ‍্যমে দেশীয় প্রথায় তাদের আত্মার সদ্গতি কামনা করা হয়। এ উপলক্ষে বদরপুরে সংগ্রাম কমিটির অফিসে প্রয়াত মাওলানা আব্দুল জলিল চৌধুরী সাহেবের সভাপতিত্বে অনুষ্টিত স্মৃতিচারণ সভায় মাওলানা নয়ীম উদ্দিন সাহেব ক্বোরআন পাঠ করেন। বিরুদ্ধবাদীরা একাজ ধর্মবিরোধী আখ‍্যা দিয়ে প্রয়াত মাওলানা সাহেবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে প্রচারপত্র বিলি করেন। এর প্রতিবাদে মাওলানা সাহেবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে ১৯৬১ সালের ১৫ ই জুলাই শিলচর থেকে হাফিজ আহমদ আলী হাজারি, মুকাব্বির আলী মজুমদার, নিজাম উদ্দিন হাজারি প্রমুখ বিশিষ্ট ব‍্যক্তিবর্গ “ অপপ্রচারের প্রতিবাদ” শীর্ষক একটি আবেদনপত্র প্রচার করেন। অনুরূপভাবে ১৯৬১ সালের ৭ই আগষ্ট বদরপুর থেকে হাজি আব্দুল জব্বার, মৌলভী আজির উদ্দিন, আহসানুর রাজা চৌধুরী, আতাউর রহমান (মায়া মিয়া) ও আব্দুল মালিক প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব‍্যক্তিবর্গ “অসত‍্য গুজবের প্রতিবাদ” শীর্ষক একটি আবেদনপত্র প্রচার করে প্রয়াত মাওলানা সাহেবের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ খণ্ডন করেন। বরাক উপত‍্যকার ভাষা সংগ্রাম আন্দোলনে অবশেষে তৎকালীন দিল্লি সরকারের টনক নড়ে। প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তদানীন্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে ভাষা আন্দোলনের কারণ ও প্রতিকার মূল‍্যায়নের জন‍্য শিলচরে পাঠান। শাস্ত্রীজী ভাষা আন্দোলনের নেতৃবর্গের সঙ্গে আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে তিন সদস্য বিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদলকে দিল্লি যাওয়ার জন‍্য আমন্ত্রণ জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রণে শিলচরের খ‍্যাতনামা আইনজীবী তথা আসামের প্রাক্তন মন্ত্রী প্রয়াত আলতাফ হোসেন মজুমদার, মাওলানা আব্দুল জলিল চৌধুরী ও প্রয়াত রথীন্দ্রনাথ সেন দিল্লিতে যান। প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি পুলিশের গুলি চালনায় এগারোটি তরতাজা প্রাণ নিহত হওয়ার ঘটনায় নেতৃবৃন্দের উপর রাগে অগ্নিশর্মা হন। সেই মূহুর্তে প্রতিনিধিদলের অন‍্য দুজন সদস‍্যের অনুরোধে মাওলানা জলিল সাহেব তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যে উর্দুভাষী প্রধানমন্ত্রীকে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, গুলিচালনার ঘটনার রহস্য ও কুচক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে যথেষ্ট তথ‍্যাদি উপস্থাপন করে, বাংলা ভাষাকে সরকার স্বীকৃতি না দিলে তার ভয়ংকর পরিণতি সম্বন্ধে এমনভাবে অবহিত করেন যে, নেহেরুজী বাংলা ভাষার স্বীকৃতিদানে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে মাওলানা সাহেবের মাধুর্য‍্যপূর্ণ আলোচনায় মুগ্ধ হয়ে হাসিমুখে বিষয়টির খুটিনাটি ব‍্যাপার নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার নির্দেশ দেন। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সহিত আলোচনার শাস্ত্রী ফরমূলা তৈরি হয়। ফরমূলা অনুযায়ী দশ বছরের জন‍্য অসমীয়া ভাষার সহিত বাংলা ভাষা চালু রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয় এবং পুলিশের গুলি চালনার তদন্তের জন্য মেহেরোত্রা কমিশন গঠিত হয়। ফলে ভাষা আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত হয়। দশ বছরের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আসাম মাধ‍্যমিক শিক্ষা পর্ষদ আসামের সমগ্র মাধ‍্যমিক স্কুলসমূহে অসমীয়া ভাষা বাধ‍্যতামূলক করে নির্দেশনামা জারি করায় আবার ভাষা আন্দোলনের উত্থান ঘটে। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদানের জন‍্য মাওলানা আব্দুল জলিল চৌধুরী সাহেবকে অনুরোধ করা হয়। সকলের অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি শাসকদলের বিধায়ক হওয়া সত্বেও রাজ‍্য সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ আন্দোলনে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সভাপতির গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাওলানা সাহেবের নেতৃত্বে পরিচালিত এ আন্দোলনে প্রায় দুমাস সরকারি সমস্ত কাজকর্ম অচল হয়ে যায়। ইতিমধ্যে আসাম বিধানসভায় বাজেট অধিবেন আরম্ভ হয়। সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বরাক উপত‍্যকার মন্ত্রীসহ ১৪জন বিধায়ককে বাজেট অধিবেশন বয়কটের অনুরোধ জানানো হয়। এ আন্দোলনের ফলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কে,সি,পন্থ শিলং গোল টেবিল বৈঠকে মাওলানা চৌধুরী সাহেব সহ সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানান। এ আলোচনায় মাওলানা সাহেব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গঠণমূলক ভূমিকা গ্রহণ করেন। গোল টেবিল বৈঠকে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক পন্থ চুক্তির ফলে বাংলাভাষী জনসাধারণের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ লাভে ধন‍্য হন। মাওলানা আব্দুল জলিল চৌধুরী সাহেবের বলিষ্ট নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন সাম্প্রদায়িক কলহ থেকে মুক্ত থাকে। সর্বত্র প্রয়াত মাওলানা সাহেবের জয়গান চলতে থাকে। বর্তমানেও বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষার উপর আগ্রাসন অব‍্যাহত রয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে প্রয়াত মাওলানা সাহেবের বলিষ্ট নেতৃত্ব বরাক উপত‍্যকাবাসী আজও অভাববোধ করছে।🖋🖋🖋মুহাম্মদ আব্দুল ওয়ারিস🖋🖋🖋 লাফাশাইল।